ভূমিকা

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সাধারণত, জাতীয় নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য একটি তদারকি সরকার গঠন করা হয়, যা নির্বাচনকালীন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। তবে এই ব্যবস্থা বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত হয়েছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিবন্ধে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমস্যা, সম্ভাবনা এবং সাফল্য পর্যালোচনা করা হবে।


অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা ও কাঠামো

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা প্রথম আসে ১৯৯৬ সালে, যখন সাংবিধানিক সংশোধনের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ তদারকি সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাসীন সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে নির্বাচন পরিচালনা করা। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল করা হয়, যার ফলে পরবর্তী নির্বাচনগুলো ক্ষমতাসীন দলের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।


সমস্যা

১. রাজনৈতিক বিতর্ক ও অস্থিরতা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ বরাবরই প্রবল। বিরোধী দল সাধারণত দাবি করে যে, এটি ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল এই ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নাকচ করে দেয়। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যা অর্থনীতি ও প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

২. সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জ

সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে। তবে বিরোধী দলগুলোর দাবি অনুযায়ী এই ব্যবস্থাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলে সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। একদিকে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে সংবিধানের বিধান পরিবর্তনের প্রশ্ন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

৩. প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি বড় সমস্যা হলো প্রশাসনের নিরপেক্ষতা। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়, ফলে অন্তর্বর্তী সরকার থাকলেও প্রশাসনের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ থেকে যায়।

৪. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকার থাকলেও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।


সম্ভাবনা

১. নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি

যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষভাবে কাজ করে, তবে এটি দেশের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। এতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে এবং রাজনৈতিক সংঘাত কমতে পারে।

2. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়ন

একটি গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা থাকলে বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বয়কটের পথ বেছে নেবে না। ফলে নির্বাচনকালীন সহিংসতা হ্রাস পাবে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।

৩. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা বৃদ্ধি

গণতান্ত্রিক নির্বাচনী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশ বেশি গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এটি দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়নে সহায়ক হবে।

৪. প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বাড়ানো

যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশাসনিক কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কার আনতে পারে, তবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কমানো সম্ভব।


সাফল্য

১. ১৯৯৬ সালের নির্বাচন

বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৯৯৬ সালে সফলভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছিল, যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।

২. ২০০৮ সালের নির্বাচন

২০০৭-২০০৮ সালে সামরিক সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক সংস্কার ও দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল, যার ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচন তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়।

৩. ভোটারদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে পরিচালিত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণের হার বেশি ছিল, যা এর গ্রহণযোগ্যতার একটি বড় নিদর্শন।


উপসংহার

বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। একটি গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা থাকলে নির্বাচন আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হতে পারে, যা দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও আইনি কাঠামোর যথাযথ সংস্কার অপরিহার্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *